একজন ভালো ডাক্তারকে প্রায়শই তাঁর ‘ভিজিট’ দিয়ে মাপা হয়। অর্থাৎ যে ডাক্তারের ফি যত বেশি, তিনি তত ‘ভালো’ ডাক্তার। এই শহুরে মানসিকতাকেই মূলধন করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন এক শ্রেণীর ডাক্তার। দেখা যাচ্ছে শহরাঞ্চলে বাস করেন ৮০-৮৫ শতাংশ ডাক্তার। আমরা একবারও ভেবে দেখি না ‘ভালো’ ডাক্তারদের মধ্যে কতজন মানবিক গুণসম্পন্ন। শহর এলাকায় একজন রোগী যেভাবে তাঁর ফি দিতে পারেন, গ্রামের মানুষ সেভাবে পারেন না। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে ভূটানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সুযোগ্য প্রাক্তন ছাত্র ডা. লোটে শেরিং বলেছেন, ভাল ডাক্তার হতে হলে আগে ভালো মানুষ হতে হবে। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের মানুষের জন্য কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। প্রিয় লেখক গোলাম মর্তুজা তার লেখায় বলেছেন- চিকিৎসা সেবা ও ডাক্তার প্রসঙ্গ উঠলেই শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ। রোগী, রোগীর পরিজন, বন্ধু কেউ খুশি নন ডাক্তার-হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে। ডাক্তারদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ, এর সবই কি সত্যি? কিন্তু তার মাঝেও কিছু মানবিক ডাক্তার সমাজের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে নিরবে। শত আলোচনার মাঝে এগিয়ে যাওয়া মানবিক এক ডাক্তার ডা. রেজাউল করিম মনছুর, কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার গ্রামের মেঠোপথে বেড়ে উঠা একজন। কর্মস্থলের কারনে জেলা সদরে নীরবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন নিজ ভূমের মানুষের। শহরে বসে গ্রামের মানুষের সেবা করে যাওয়া এখন তার নিয়মিত আয়োজন। রাত ২.২৫ মিনিট ঘুমাতে চেষ্টা করছি খুব। হঠাৎ গ্রাম থেকে একটি ফোন আসল রিসিভ করলাম দেখছি গ্রামের খুব একজন অসহায় মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে, বলছি কক্সবাজারে নিয়ে আসতে, কথামতো রোগীটাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে আসলো রাত ৩টা ১০ মিনিটে, জরুরী বিভাগের ডাক্তার বললো রোগীটি ব্রেইন স্ট্রোক করেছে, পরামর্শ দিলেন সাথে সাথে চট্টগ্রাম নিয়ে যেতে। কিন্তু এই অসহায় পরিবারের ছিল না কোন টাকা পয়সা, আমি চিন্তা করতে করতে একজন ডাক্তারের পরামর্শে অনেক ভয়ে ফোন দিলাম একজন নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞকে। ফোন দেওয়ার সাথে সাথে রিসিভ করলেন, সবকিছু খোলে বলেছি, বলার সাথে সাথে আমাকে বললেন রোগী কোথায় আছে, আমি আসতেছি, ঠিক ১০ মিনিট পর ডাক্তার মহোদয় হাজির হয়ে রোগীটা দেখলেন ইন্টার্নি ডাক্তারদের পরামর্শ দিলেন চিকিৎসা শুরু করতে, বলে দিলেন কোন চিন্তার কারণ নাই, রোগীকে চট্টগ্রাম নিয়ে যেতে হবে না কক্সবাজারেই চিকিৎসা চলবে চট্টগ্রামে নেওয়ার কোন দরকার নাই। এমন একজন মানবিক ডাক্তারের অনন্য সেবার কথা ভুলতে পারছি না কিছুতেই।
সব শেষে হাসিমুখে ফিরে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, জব ইজ ডান। আমি কেবল ভদ্রলোক ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছি। একজন সিম্পল লাইফ লিড করা, উন্নত ও মার্জিত আচরণ করা ডাক্তারের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে অনেককিছু ভাবছিলাম। উনাকে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল। অনেককিছু… সামনা-সামনি একটা ধন্যবাদও দিতে সাহস পাইনি। এক বটবৃক্ষের ছায়ায় শীতল মুসাফির যেন প্রশান্তচিত্ত ও নির্বাক ডাক্তার লাভ ইউ? এতক্ষণ যার কথা বলছি তিনি হলেন কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা: এ এম এম রেজাউল করিম মনছুরের কথা। এরকম আর ও অনেক উদাহরণ আছে, অন্তত হ্নীলার মীর কাশেম চেয়ারম্যান এর ছেলে জাহাঙ্গীর এর কথা বলতে পারি যাকে সব ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিলেন সাথে সাথে চট্টগ্রাম নিয়ে যেতে, তিনিই চট্টগ্রাম নিয়ে যেতে হবে না কক্সবাজারেই চিকিৎসা চলবে এবং তিনি সম্পূর্ন সুস্থ হন ২ দিনের মধ্যে। কয়েকজন পরিচিত ডাক্তারের কথা শুনে আমি অবাক যিনি নাকি কক্সবাজারের বাহিরে থাকলে ওনার দাম হত অতুলীয়। তারপরেও জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে নিজের জন্মভূমি এবং নিজ শহরের মানুষকে ভালোবেসে পড়ে আছেন কক্সবাজারে। তিনি কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের একজন সফল শিক্ষক। তিনিই কক্সবাজারে একমাত্র আধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতিতে ব্যবস্থাপত্র প্রদান করেন ও ডাটা সংরক্ষণ করেন।
একটু পিছনে ফিরে গেলে বেরিয়ে আসে তিনি শিক্ষাগত জীবনে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নাম্বার নিয়ে এম,বি,বি,এস পাস করেন এবং ফলে তিনি ইউ, জি, সি গ্রান্ড কমিশন, ঢাকা মেডিকেল ১৯৫৬ ক্লাব ও ইবনে সিনা ট্রাস্ট সহ অসংখ্য সংস্থার বৃত্তি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশের কনিষ্ঠ সহযোগী অধ্যাপকদের একজন। ‘একজন সফল শিক্ষক’ পিতার সন্তান ডা: রেজাউল করিম মনছুর- কক্সবাজার জেলার চকরিয়া খুটাখালী ইউনিয়নস্থ আলহাজ্ব মৌলানা ছৈয়দ আহাম্মদ। তিনি খুটাখালী তমিজিয়া ইসলামীয়া ফাজিল মাদ্রাসা ও খুটাখালী বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক।
শিক্ষক পিতার ৬ সন্তানের মধ্যে ১ম ছেলে: ডা: রেজাউল করিম মনছুর এফসিপিএস (মেডিসিন) এমডি (নিউরো মেডিসিন)। স্ত্রী-ডা: নাজমা আক্তার, কিউরেটর, প্যাথলজী বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। উল্লেখ্য, ডা: নাজমা আক্তার এর পরিবারে সবাই ডাক্তার ও বিসিএস অফিসার হওয়ায় মাতা মিসেস রেহেনা ইসলাম ২০১৯ সালের রতœগর্ভা মা হিসেবে ভূষিত হন।
২য় ছেলে: শহীদুল করিম, এমএম (কামিল), পরিচালক – খুটাখালী মেডিক্যাল সেন্টার, মৌলানা এন্টারপ্রাইজ ও ব্যাংক এশিয়া এজেন্ট ব্যাংক। স্ত্রী- জুনাইদা ইয়াছমিন (কামিল), সহকারী শিক্ষক, খুটাখালী বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়।
৩য় ছেলে- এরশাদুল করিম, এমবিএ, এক্সিকিউটিভ অফিসার, ব্যাংক এশিয়া লোহাগাড়া ব্র্যাঞ্চ। তাহার স্ত্রী- আকলিমা শাম্মি, বিসিএস (শিক্ষা) প্রভাষক, সরকারী সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম।
১ম মেয়ে- হামিদা আক্তার, সিনিয়র শিক্ষক, লামা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। স্বামী- মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, বিএ (অনার্স) এমএ (চবি), এমএড, প্রধান শিক্ষক, আলীকদম সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়।
২য় মেয়ে- তৌহিদা আক্তার, বিএ (অনার্স) এমএ, সহকারী অধ্যাপক, দেওয়ানহাট সিটি কর্পোরেশন কলেজ, চট্টগ্রাম। স্বামী- মোঃ শাহী নেওয়াজ, সহকারী পরিচালক, জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম।
৩য় মেয়ে- সানজিদা খানম আসমা, বিএ (অনার্স), এমএ, প্রবাসী (চেক প্রজাতন্ত্র)। স্বামী- ড: জিয়াউল হক, পিএইচ ডি (ফ্রান্স) সহকারী অধ্যাপক, নিউক্লিয়ার রিসার্স সেন্টার, প্রাগ, চেক প্রজাতন্ত্র।
পরিশেষে বলব, আমার মতো সাধারণ মানুষের জীবন কদিনই বা স্বরণীয় হয়? তবে ওই দিনের আমার মতো মানুষ কজন বড় মানুষের স্নেহধন্য হয়েছে? আজ আপনার মতো মানবিক ডাক্তার বাংলাদেশে আছে, যিনি একজন কাঠ শ্রমিকের ব্যাথায় কেঁদে ওঠেন। মেঘে ঢাকা আকাশ দেখে সিদ্ধান্ত নিও না, রাতে অনেক তারা দেখতে পাবে। স্যালুট টু ইউ ব্রাদার। তবুও আজ বলতে হয় দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির এতদিন পরেও দেশের দুঃখ গুছেনি। এই পরিস্থিতি এবং উপলব্ধি টুকু নিয়ে ভাবতে হবে ডাক্তারদের। একজন ডাক্তার তৈরি করতে গেলে সরকারকে অনেক সাধারণ মানুষের করের টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। একথা যেন তাঁরা ভুলে না যান। রোগী মানে মানুষ, শুধু অর্থোপার্জন নয়।
লেখক: এম. ওসমান গণি
সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত), দৈনিক আপনকণ্ঠ।
ইনাম/সময়নিউজবিডি টোয়েন্টিফোর।
Leave a Reply